রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে নিজের সৌন্দর্য উজাড় করে দেয়। চারিদিক দারুণ মিষ্টি গন্ধে শুভাশিত হয়ে উঠে। নিত্যমনের সুখে জোনাকিরা নেচে বেড়ায়৷ কালচে সবুজ ডাল-পাতার ফাঁকে গোল গোল বড় চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে লক্ষী-প্যাঁচা। বলছি,চিরহরিৎ হিজলের কথা।
Lecythidaceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত মাঝারি আকারের ডালপালা ছড়ানো দীর্ঘজীবী গাছের নাম হিজল। যার বৈজ্ঞানিক নাম Barringtonia acutangula. সংস্কৃত নাম নিচুল। যার আদি নিবাস বাংলাদেশ,দক্ষিণ এশিয়া, মালয়েশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া। খাল, বিল, নদী-নালা, হাওর, বাঁওড়, ডোবার ধার এবং নীচু জলাবদ্ধ এলাকার তীরভূমিতে জন্মে বলে একে জলন্ত বা নদীক্রান্ত নামেও ডাকা হয়।
প্রকৃতিতে অনন্য সৌন্দর্যের বিকাশ ঘটায় হিজল ফুল। হিজল ফুল দেখতে খুবই চমৎকার। হালকা গোলাপি রঙের ১০-১২ সেমি লম্বা পুষ্পদণ্ডের মাঝে অসংখ্য ফুল ঝুলন্ত অবস্থায় ফোটে। সকালে ঝরে যায়। ফুলের বিছানায় পরিণত হয় হিজলতলা। গ্রামগঞ্জে পানির ওপর পরা হিজল ফুলের আস্তরণের চেনা রূপ দেখে অনেকে মুগ্ধ হন। রাতে বা ভোরে হিজল তলার সামনে দিয়ে গেলে মিষ্টি ঘ্রাণে মাতাল করে। প্রথমে গাছের শাখা-প্রশাখায় সবুজ রঙের অসংখ্য ঝুলন্ত মঞ্জরি দেখা যায়। এরপর গুটি গুটি ফুলকলি। নির্দিষ্ট সময় পর ফুল কলি ও মঞ্জরির রং পরিবর্তন হয়ে গোলাপি লাল রং ধারণ করে। চারদিক আলোকিত করে ফোটে ফুল। গাছের সবুজ পাতা ও শাখা-প্রশাখার নিচে লম্বা মঞ্জরিতে গোলাপি লাল রঙের রেশমি কোমল ফুল দেখতে বড়ই মনোরম।
কবি জীবনানন্দ দাশ হিজল গাছের সৌন্দর্য নিয়ে একাধিক কবিতা রচনা করেছেন। শুধু মাত্র এক ‘রুপসী বাংলা’তেই বাংলার অপরুপ সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি ৯বার হিজলগাছের নাম নিয়েছেন। রূপসী বাংলা প্রকাশিত হয় কবির মৃত্যুর পর। তার মৃত্যুর তিন বছর পর ১৯৫৭ সালে কলকাতার সিগনেট প্রেস থেকে বইটি বেরুলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ধারণা করা হয়,তিনি ১৯৩৪ সালের দিকে কবিতাগুলো লিখেন।
রুপসী বাংলায় তিনি বলেছেন
“এমনই হিজল-বট-তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ”
হিজলের ফুলে ফুলে যখন হিজলতলা ভরে উঠেছে,তখন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সেই হিজলফুলের সজ্জিত পথ দিয়ে তার প্রিয়াকে হেটে আসার আহবান জানান। তিনি বলেন,
“হিজল বিছানো বন পথ দিয়া
রাঙায়ে চরণ আসিবে গো প্রিয়া।”
শুধু কবিরাই নন,হিজলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও।
তার বাড়ির পিছন দিক দিয়ে বয়ে যাওয়া বাঘিয়ার খালে গোসল করতেন তিনি। সাথে থাকতেন সমবয়সীরা। খালের পাড়ে থাকা হিজলগাছে উঠে খালের পানিতে লাফিয়ে পড়তেন। ছোট বেলায় দুরন্ত খোকা হিজল ফল নিয়ে খেলা করতেন। ফলগুলো দেখতে অনেকটা হরতকীর মতো। রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ করার পরেও টুঙ্গিপাড়ায় আসলে তিনি এই হিজলতলায় যেতেন। এলাকার মানুষ আর বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতেন এখানেই। সেই বাঘিয়ার খালের হিজল গাছটি আজও নানা স্মৃতির সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
হিজল ঔষধিগুণ সম্পন্ন এক বৃক্ষের নাম। মাথা ব্যথা ও কপালে যন্ত্রনা হলে হিজল বীজ শুকিয়ে গুড়াে করে দুই চামচ পরিমাণ এক কাপ দুধসহ সকালে এবং বিকেলে খেলে মাথা যন্ত্রনা কমে যায়। যদি পেটে গ্যাস হয়, ঢেকুর উঠে,পেট ফেপে যায় তাহলে হিজল বীজ চূর্ণ করে খেলে উপকার পাওয়া যায়। হিজল বীজ চূর্ণ করে গরম মসলাসহ খেলে কিছুক্ষনের মধ্যে বমি বমি ভাব কেটে যাবে। চোখ উঠলে চোখ লাল হয়, চুলকায়,পানি পড়ে। তাহলে হিজল বীজ নিয়ে পাটা-পুতায় ঘসে চন্দনের মত চোখের চারি পাশে লাগিয়ে দিলে উপকার পাওয়া যায়। হিজল বীজ চূর্ণ করে গরম পানি দিয়ে সেবন করলে ডায়রিয়া ভালো হয়।
খাল, বিল, নদী-নালা, হাওর, বাঁওড়, ডোবার ধার এবং নীচু জলাবদ্ধ এলাকার তীরভূমিতে হিজল গাছ জন্মায়। হিজলগাছগুলো থেকে ফুল-ফল খাল ও নদীর পানিতে পড়ে। হিজলের ফুল ও ফল মাছেরা খেতে পারে। এজন্য নদী-নালা,খাল,বিল আর হাওরের কিনারায় হিজল গাছ থাকা একান্ত প্রয়োজন।
প্রকৃতি থেকে ধীরে-ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে হিজলের অস্তিত। আমাদের দেশে কোনো কোনো অঞ্চলে উঁচু জমির আলপথে, কাঁচা রাস্তার পাশে হিজল দেখা যেত। এসব গাছ যেমন পানিতে বেঁচে থাকতে পারে তেমনি প্রচন্ড খরায়ও মরে না। বর্ষাকালে হিজল বন বর্ষার পানিতে ডুবে যায়, ভেসে থাকে গাছের অগ্রভাগ মাত্র। জেলেরা হাওরে মাছ ধরতে গিয়ে ঝড়ের কবলে পড়লে নৌকা হিজল ও অন্যান্য গাছের সঙ্গে বেঁধে জান বাঁচাতেন। মাছ, সাপ ও পাখি আশ্রয় নিতো এসব গাছে। প্রাকৃতিক শোভা ও সৌন্দর্য বর্ধনকারী এসব গাছ আজ হাওর থেকে প্রায় হারিয়েই গেছে বলা চলে। অথচ হিজল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্ভিদ। একে রক্ষায় সকলের এগিয়ে আসা উচিত। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে হিজলগাছ লাগানোর ব্যবস্থা করা জরুরি। তা না হলে ভবিষ্যতে বিখ্যাত হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সঙ্গে আমাদেরও সুর মিলাতে হবে-
“হাওরের পানি নাই রে হেথায়, নাই রে তাজা মাছ
বিলের বুকে ডালা মেলা, নাই রে হিজল গাছ।”
Your article helped me a lot, is there any more related content? Thanks!